ওয়েব ডেস্ক; ১০ ফেব্রুয়ারি: ‘বুদ্ধি থাকলে না খেয়ে মরতে হয় না অন্তত। উপার্জন করার অনেক রাস্তায় খোলা আছে’— এটা প্রদীপ্তর বক্তব্য। শহর থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে প্রদীপ্ত বাড়ী হলেও, শহরের সব রকম ক্রিয়াকর্মের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছে। মফস্বলের বাড়িতে দুটো ছেলেকে দিয়ে কুড়ি লিটারের খাবার জলের ড্রাম ভর্তি করে শহরে বিক্রি করে। ও শুনেছে, শহরের বাবুরা আজকাল মিনারেল ওয়াটারে স্নান করতেও নাকি চাইছে।
প্রদীপ্ত স্নানের জলে বিষয়টি নিয়েও আজকাল ভাবছে। যদি স্নানের জল সাপ্লাই শুরু করতে পারে, তবে তো কেল্লা ফতে।
ওর কাছে কাজ করা ছেড়ে দুটোর মধ্যে প্রদীপ্ত সুকান্তকে বেশি পছন্দ করে। ছেলেটি স্বল্পভাষী এবং বিশ্বাসী। কিন্তু ওকে ভালোলাগার অন্য কারন। সেটি হল ওর একটি কথার মাধ্যমেই প্রদীপ্তর নতুন ব্যবসার জন্য মাথা খুলে গিয়েছিল।
সেদিন সকালে কাজে এসে সুকান্ত বলেছিল,
- দাদা কালকে আমি আসবো না ডিউটিতে। বাড়িতে কাজ আছে, আজেন্ট।
সুকান্ত দাঁত খিঁচিয়ে বলেছিল,
-ওটা আজেন্ট না, আর্জেন্ট। কিন্তু সুকান্ত, রবি একা অত মাল রেডি করতে পারবে!! বারো তলা ফ্লাটে কাল থেকে কুড়ি ইউনিট লাগবে।
ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে প্রদীপ্তর কথা শুনছিল সুকান্ত। শোনা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। কোনভাবেই ও কাল আসতে পারবে না। গরিব ঘরের ছেলে, এখানে কাজের পারিশ্রমিকের হিসেব হলো, প্রতি ইউনিটে পাঁচ টাকা করে পাবে।
রাস্তার কল থেকে জল ভরে প্রদীপ্তর অবসরপ্রাপ্ত গোয়াল ঘরে রাখা হয়। ওটাই হচ্ছে ওদের মিনারেল ওয়াটার প্লান্ট। তিনশটি পুরনো জলের জার কিনে প্রদীপ্ত ব্যবসা শুরু করেছিল। রাস্তার কলের জল ভরে ঢাকনা লাগিয়ে সিল করলেই পঞ্চাশ টাকা। দোকানের সাপ্লাই করলে লস্। সেখানে বিক্রির পাইকারি দাম হল কুড়ি টাকা। তাই প্রদীপ্ত বড় বড় হাইরাইজগুলোকে ধরেছে, হোম ডেলিভারি ফ্রিতে দেয়।
প্রদীপ্তর কথা শুনে মনটা খারাপ লাগলেও সুকান্তর বিশ্বাস, যে প্রদীপ্ত ওকে ছুটি দেবে। তবুও বলল,
-রবিকে বলেছি দাদা, সামলাতে পারবে বলেছে।
সুকান্তর পীড়াপীড়িতে মনে একটা সন্দেহ লাগছে প্রদীপ্তর। সুকান্ত যদি কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে তো ভীষণ বিপদ। তাই এক্ষেত্রে প্রদীপ্ত একটু বাজিয়ে দেখতে চাইছে। একটু থেমে বলল,
-সুকান্ত তুই কাল ছুটি না নিয়ে পরশুদিন নে না। সুকান্ত বলল,
- দাদা জন্মদিন তো কাল। পরশু ছুটি নিয়ে কি হবে?
অবাক হয়ে গেল প্রদীপ্ত। তারপরে বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করল,
-মানে?? কার??
হেসে ফেলে সুকান্ত বলেছিল, আমার। ঐ দিন বাবা প্রতিবছর একটা করে উপহার এনে দেয় কবি সুকান্তকে মনে রেখো।
বিদ্যুৎ গতিতে বুদ্ধি খুলে গেল ধুরন্ধর প্রদীপ্তর। ছোট্ট করে সুকান্তকে বলল, যা তাহলে।
সুকান্ত চলে যেতেই প্রদীপ্ত বুদ্ধি এবার নতুন করে ডানা মেলতে শুরু করলো। ওকে এই নতুন প্রজেক্ট নিয়ে ভাবতে হবে।
কুড়িটা জল সকালে সাপ্লাই দিয়ে প্রদীপ্তকে আজ আবার কলকাতা যেতে হবে। এলাকার বেশ কিছু খবর তিনটে বিভিন্ন পাক্ষিক আর একটা মাসিক পত্রিকাতে দেওয়া আছে, সেগুলো ডেলিভারি আনতে হবে। প্রদীপ্ত ওর এলাকার ছোটখাটো সংবাদ কলকাতার পেপারে ছাপিয়ে নিয়ে আসে এখানে। হিসেব করে দেখেছে, প্রতি খবরের জন্য খবরের কাগজ কিনে এনে যাদের সংবাদ তাদেরকে যখন দেয় তার থেকে প্রাপ্ত টাকা খুব ভালো না হলেও যাতায়াতের খরচটা উঠে যায়। উপরি পাওনা হল অঞ্চলে এবং কলকাতাতেও ‘সাংবাদিক’ বলে একটা পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও ছোট পত্রিকার সম্পাদক অধীরদা, বিকাশ অথবা নম্রতাদি মাঝে মাঝে ঠেস্ দিয়ে কথা বলে। তা বলুক, প্রদীপ্ত ওসব একেবারেই গায়ে মাখে না। ওর কথা হলো ‘পথে চলতে গেলে পায়ে কাদা লাগবে, জল দিয়ে ধুয়ে ফেললেই হলো। পা নষ্ট হয়ে যাবে নাকি তাতে? ‘
সংসার বলতে শুধু মা। প্রদীপ্তর বেশ কয়েক বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বছর দুই আগে বউ চলে গেছে, ডিভোর্সও হয়ে গিয়েছে। তাই টাকার জন্য খুব একটা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে না। তবে সুকান্ত যে নতুন ধান্দার আর একটা দিক খুলে দিয়েছিল সেটা দিয়ে কিছু একটা প্রদীপ্তকে করতেই হবে।
জলের পয়সাগুলো ব্যাঙ্কে রেখে বাড়ি আসার পথে পচা খালের মোড় পার হতেই পেটটা চিনচিন ব্যথা করছে। বাসি রুটি আর চা দিয়ে টিফিন সেরে এখন বেলা বারোটা। পেটের আর দোষ কোথায়, খিদে তো পাবেই। দোলাদির বাড়ির সামনে এসে মিনমিনে স্বরে ডাক দিল প্রদীপ্ত,
- ও দোলা দি, এত তাড়াতাড়ি ঘুমালে নাকি ?
প্রায় তিরিশ সেকেন্ড পর দরজা খুলে মুখ বাড়ালেন দোলাদি। বছর ষাটের এই মহিলা যৌবনে ‘আদ্যন্ত আপেরার’ অভিনেত্রী ছিলেন। তার জীবনে, মানে অভিনয় জীবনে তেমন স্বীকৃতি না পাওয়ার জন্য মনে এখনো দুঃখ পোষেন তিনি। প্রদীপ্ত তার বাড়িতে আসলে চা-কেক এবং বিস্কুট সহযোগে সেই দুঃখের স্মৃতি রোমন্থন হয় ঘন্টা দুই। প্রদীপ্ত ওনার কাছে খুবই প্রিয় পাত্র। দোলাদির স্বামী গত হয়েছেন বছর দশ আগে। একটিমাত্র ছেলে দেশলাই কারখানাতে সুপারভাইজার চাকরি করে। দোতলা বাড়ির উপরতলায় দুটো ভাড়াটে রয়েছে। আর নিচে তলায় ছেলেকে নিয়ে থাকেন। এই মুহূর্তে গল্প করার সাথী প্রদীপ্তকে দেখে একগাল হেসে বললেন,
- কোথায় থাকিস সারাদিন বলতো, ভেতরে আয়।
(চলবে)