ডা. চন্দ্রগুপ্ত
ধর্মীয় বিশ্বাস ভিন্ন-তাই পরস্পর পরস্পরের শত্রু, তাই পরস্পরের পোশাক-খাদ্য-আচার নিয়ে চলে টিপ্পনী। এমনকি পরলোকগত শ্রদ্ধেয় মানুষদের কর্মপদ্ধতির চুলচেরা বিশ্লেষণে আমরা সিদ্ধহস্ত। আসলে অন্যের প্রশংসা করার মত বড় হৃদয় আমরা তৈরি করতে পারিনি। জনৈক ব্যক্তির কথা নিয়ে চা দোকান অথবা ক্লাবের আড্ডায় সমালোচনার ঝড় তুলি। কিন্তু তার ভালো কাজগুলো চাপা পড়ে যায় আমাদের সমালোচনার তুফানে।
একবার কি ভেবে দেখেছি যে আমাদের কোনো ভালো কাজকে আড়াল করে যখন মানুষ সমালোচনার ঝড় তোলে, তখন ভালো কাজ গুলো থেকে যায় দলিল হয়ে। যা হয়তো অনেক বছর পরে পর্যালোচনায় প্রেক্ষিতে উঠে আসবে জনমানুষের। যে মাদার টেরিজাকে আমরা আজ ‘সেইন্ট’ বলছি তাকেও পড়তে হয়েছিল বহু প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে গিয়ে ব্রাহ্মণ সমাজের রোষে পড়তে হয়েছিল, সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। তথাপি বর্ণপরিচয় এবং বিধবা বিবাহ প্রচলন এর সাথে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অমলিন রয়েছেন আমাদের মননে। দেশের অন্যতম সেরা মানুষ ডক্টর এ পি জে আবদুল কালাম সাহেব এর কথন বাণীর মতো ঘুরছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। একটা সময় তাকে হয়তো বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা এবং সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তবে ব্রিটিশ সৃষ্ট ইতিহাস কিন্তু বহু মানুষকে আমাদের কাছে ঘৃণ্য তৈরি করেছে, পরিণত করেছে শত্রুতে।
দেশের অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব টিপু সুলতান পিতা হায়দার আলীকে অনুসরণ করে তার শাসনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দুদের নিয়োগ করেছিলেন। পাশে নিয়েছিলেন আপ্পাজি রাম এবং শ্রীনিবাস রাওকে। তারা অভিভাবকের মতো টিপুর পাশে থাকতেন। ১৯১৬ সালে শৃঙ্গেরী মন্দিরে রক্ষিত একগুচ্ছ চিঠি দেশবাসীর কাছে এক অন্য টিপু সুলতানের সাথে পরিচয় করিয়ে ছিল। ১৭৯১ সালের বর্গীদের আক্রমণে এই মন্দির লুণ্ঠনসহ বহু পুরোহিতদের হত্যার পর মন্দিরের স্বামীজি পালিয়ে গিয়েছিলেন কারাকলাতে। বিস্তারিত জানার পর টিপু সুলতান ২০০ রাহাতিস এবং এই মূল্যের সমতুল্য খাদ্য সামগ্রী স্বামীজীকে পাঠিয়েছিলেন। কোন চিঠিতে জানা যায় “শত চন্ডী জপ” অনুষ্ঠানে ব্যয় হওয়া অর্থের খরচের বিবরণী প্রাপ্তিরর স্বীকৃতি। কুর্গ এবং নায়ারদের আনুগত্য অর্জনে সক্ষম হতে ধর্মান্তরিত করেছিলেন এবং সেটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।
এ কথা মনে রাখতে হবে যে টিপু সুলতান কিন্তু কুর্গ এবং মালাবার ছাড়া অন্য কোন অংশে এই পদ্ধতি অবলম্বন করেন নি। পাশাপাশি মালাবারের কাছাকাছি অঞ্চলে মন্দির এবং অ-মুসলমানদের জন্য জমি দান করেছিলেন।
কখনো টিপু কর্তৃক খৃষ্টান পীড়নের অভিযোগ শোনা যায়। বাস্তবে ২য় এ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধে মহীশুরের খ্রিস্টানরা ব্রিটিশদের সহযোগিতা করেছিল। গুপ্তচরবৃত্তিতে ম্যাথুজ সাহেবকে সহায়তা করেছিলেন এরাই। রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে খ্রিস্টানদের প্রতি কঠোর হলেও ১৭৮৯ সালে লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায় যে বন্দী খ্রিস্টান যারা ধর্ম পালন করছেন না, তাদের জন্য তিনি গোয়ার ভাইসরয় এবং আর্চ বিশপকে ধর্মযাজক পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন।
সৈন্যদলে মুসলমান সৈন্যদের জোরে জোরে উপাসনার ফলে যে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হতো সেই কারণে মাহদাবিস গোষ্ঠীর দুই প্রধান মাহতাব খান এবং আলম খানকে তিনি বন্দী করেন। শুধু তাই নয় তার রাজ্য থেকে মাহদাবিস গোষ্ঠীর মানুষদের তিনি বের করে দিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ সৃষ্ট ইতিহাসের ফলে আমাদের কাছে বীর টিপু সুলতানের ভাবমূর্তি হয়তো নষ্ট হতো। কিন্তু দলিল সর্বদা সঠিক প্রমাণ দেয়। তাই ভারত মায়ের এই বীর সন্তানের ইতিহাস আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে, ভারতবাসীর হৃদয়ে সম্রাট আকবরের মতোই টিপু সুলতান শ্রদ্ধেয়।
ছবি : উইকিপিডিয়া